শিশু বিকাশ বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়, এবং প্রতিটি পর্যায়ে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং আবেগগত পরিবর্তন ঘটে। বিকাশের পর্যায় (Stages of development) বয়স অনুযায়ী নির্ধারিত হয়, যা সাধারণত নিম্নলিখিত ধাপে বিভক্ত করা যায়:
বিকাশের পর্যায় (Stages of development)
১. প্রাক-জন্মকাল (Prenatal Stage) [গর্ভাবস্থা]:
- বয়স: গর্ভধারণ থেকে জন্ম পর্যন্ত (০-৯ মাস)।
- এই পর্যায়ে বিকাশ শুরু হয় এবং শিশুর শরীরের সব অঙ্গ ও কাঠামো তৈরি হয়। মায়ের পুষ্টি, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের প্রভাব এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- গর্ভাবস্থায় শিশুর মস্তিষ্ক এবং শারীরিক গঠন বিকশিত হতে শুরু করে।
২. শিশুকাল (Infancy) [জন্ম থেকে ২ বছর]:
- বয়স: জন্ম থেকে ২ বছর পর্যন্ত।
- এই সময় শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি খুব দ্রুত হয় এবং সে আশেপাশের জগত সম্পর্কে তার ইন্দ্রিয় ব্যবহার করে বোঝার চেষ্টা করে।
- শিশুরা হাসতে, বসতে, হামাগুড়ি দিতে, হাঁটতে, এবং কথা বলা শুরু করে।
- বন্ডিং বা সুরক্ষা অনুভূতি তৈরি হয়। শিশুরা তাদের প্রাথমিক সংযুক্তির জন্য বাবা-মা বা পরিচর্যাকারীদের উপর নির্ভর করে।
৩. প্রারম্ভিক শৈশবকাল (Early Childhood) [২-৬ বছর]:
- বয়স: ২ থেকে ৬ বছর।
- এই পর্যায়কে প্রিস্কুল বছরও বলা হয়। এই সময়ে শিশুর মোটর দক্ষতা, ভাষা, এবং সামাজিক দক্ষতার বিকাশ ঘটে।
- শিশুরা কথা বলা, দৌড়ানো, আঁকাআঁকি করা এবং ছোট ছোট সমস্যা সমাধান করতে শেখে। ভাষাগত এবং জ্ঞানগত বিকাশ দ্রুত ঘটে।
- শিশুরা সামাজিক হতে শুরু করে এবং নিজেদের চারপাশের জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে।
৪. প্রাথমিক শৈশবকাল (Middle Childhood) [৬-১২ বছর]:
- বয়স: ৬ থেকে ১২ বছর।
- এই সময় শিশুরা বিদ্যালয়ে যায় এবং তাদের সামাজিক জীবন বিকাশ লাভ করে। এটি স্কুল বয়সের শিশুদের প্রধান বিকাশকাল।
- বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে এই সময়ে বড় অগ্রগতি ঘটে এবং শিশুদের শিক্ষাক্ষেত্রে যুক্তিবাদী চিন্তা করার ক্ষমতা তৈরি হয়।
- শিশুরা সমাজের নিয়ম এবং অন্যদের সাথে সম্পর্কিতভাবে আচরণ শেখে।
- শারীরিকভাবে তারা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং খেলা, খেলাধুলা ও অন্যান্য কার্যক্রমের মাধ্যমে তাদের শক্তি এবং সহনশীলতা বৃদ্ধি পায়।
৫. কৈশোরকাল (Adolescence) [১২-১৮ বছর]:
- বয়স: ১২ থেকে ১৮ বছর।
- এটি শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সময়কাল। এই সময়ে শারীরিক ও হরমোনজনিত পরিবর্তনগুলো দ্রুত ঘটে, যার ফলে প্রজনন ক্ষমতা তৈরি হয় (যেমন: মেয়েদের ঋতুস্রাব শুরু হয় এবং ছেলেদের গলার স্বর ভারী হয়)।
- মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রেও এই সময় গুরুত্বপূর্ণ। আত্মপরিচয় তৈরি হওয়া এবং স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া শেখা এই পর্যায়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
- আবেগগত ও সামাজিক বিকাশে পরিবর্তন আসে, যেমন: আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি, সম্পর্ক গড়ার দক্ষতা এবং নতুন নতুন সামাজিক ভূমিকায় অভ্যস্ত হওয়া।
- কিশোর-কিশোরীরা বন্ধুদের সাথে বেশি সময় কাটায় এবং সমাজের বিভিন্ন মূল্যবোধ, নিয়ম এবং আদর্শ সম্পর্কে সচেতন হয়।
৬. প্রারম্ভিক প্রাপ্তবয়স্কত্ব (Early Adulthood) [১৮-২৫ বছর]:
- বয়স: ১৮ থেকে ২৫ বছর।
- যদিও এটি শৈশব থেকে বেরিয়ে আসার একটি ধাপ, তবে শারীরিক, মানসিক, এবং সামাজিকভাবে সম্পূর্ণ প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া এই পর্যায়ে ঘটে।
- শিক্ষা, কর্মজীবন, সম্পর্ক এবং স্বাধীন জীবনযাপনের সাথে সংযুক্ত বিষয়গুলি এখানে গুরুত্ব পায়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা উন্নত হয় এবং জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে।
বিকাশের প্রতিটি পর্যায়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য:
বিকাশের পর্যায় | প্রধান বৈশিষ্ট্য |
---|---|
প্রাক-জন্মকাল (Prenatal) | শারীরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গঠন এবং বিকাশ। |
শিশুকাল (Infancy) | শারীরিক বৃদ্ধি, চলাফেরা শেখা, ইন্দ্রিয়ের ব্যবহার। |
প্রারম্ভিক শৈশবকাল (Early Childhood) | ভাষা, সামাজিক দক্ষতা এবং মোটর দক্ষতার বিকাশ। |
প্রাথমিক শৈশবকাল (Middle Childhood) | শিক্ষাগত এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতার বিকাশ, সামাজিক সম্পর্ক। |
কৈশোরকাল (Adolescence) | শারীরিক ও আবেগিক পরিবর্তন, আত্মপরিচয় এবং স্বাধীনতা খোঁজা। |
প্রারম্ভিক প্রাপ্তবয়স্কত্ব (Early Adulthood) | জীবনযাত্রার লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হওয়া, সম্পর্ক এবং কর্মজীবন। |
বিকাশের ধারণা এবং নীতি (Concept and Principles of Development)
বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়- বিস্তারিত
সদ্যজাত (Infancy) [জন্ম থেকে ২ বছর]
সদ্যজাত (Infancy) হল জন্ম থেকে ২ বছর পর্যন্ত সময়কাল, যা শিশুর বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই পর্যায়ে শিশুর শারীরিক, সামাজিক, বৌদ্ধিক (কগনিটিভ), মানসিক, এবং ভাষাগত বিকাশ শুরু হয় এবং দ্রুত অগ্রসর হয়। নিচে প্রতিটি দিকের বিশদ আলোচনা করা হলো:
১. শারীরিক বিকাশ (Physical Development):
সদ্যজাত শারীরিক বিকাশ খুব দ্রুত ঘটে। এই সময়কালে শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি এবং নড়াচড়ার ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়।
প্রধান বৈশিষ্ট্য:
- ওজন ও উচ্চতা বৃদ্ধি: জন্মের পর প্রথম বছরে শিশুর ওজন প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পায়, এবং উচ্চতাও দ্রুত বাড়ে।
- মোটর স্কিল:
- মোটা মোটর দক্ষতা (Gross Motor Skills): শিশুরা প্রথমে মাথা ওঠানো শেখে, পরে হামাগুড়ি দেয় এবং ধীরে ধীরে হাঁটা শেখে। ১ বছরের মধ্যে বেশিরভাগ শিশু নিজে দাঁড়াতে পারে এবং কিছু শিশুই হাঁটতে শেখে।
- সূক্ষ্ম মোটর দক্ষতা (Fine Motor Skills): শিশু হাত ব্যবহার করে বস্তু ধরতে শেখে। প্রথমে তারা মোটা আঙ্গুল দিয়ে বস্তু ধরে, পরে সূক্ষ্ম বস্তু ধরার ক্ষমতা অর্জন করে।
- দাঁত: সাধারণত, ৬ মাস থেকে ৮ মাস বয়সের মধ্যে শিশুর প্রথম দাঁত গজানো শুরু হয়।
- ইন্দ্রিয়ের বিকাশ: শ্রবণ, দৃষ্টি, স্পর্শ, স্বাদ এবং গন্ধের অনুভূতি দ্রুত বিকশিত হয়। প্রথমে শিশুদের দৃষ্টিশক্তি পরিষ্কার না হলেও, ৬ মাসের মধ্যে এটি পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়।
২. সামাজিক বিকাশ (Social Development):
এই সময় শিশুরা তাদের পরিচর্যাকারীদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করে এবং প্রাথমিক সামাজিক দক্ষতা অর্জন করে।
প্রধান বৈশিষ্ট্য:
- আবেগিক বন্ধন (Attachment): শিশুরা পরিচর্যাকারীর সাথে একটি গভীর আবেগিক সম্পর্ক তৈরি করে। এটি ভবিষ্যতের সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তি তৈরি করে।
- বিশেষত মায়ের সাথে সংযুক্তি: বেশিরভাগ শিশু তাদের মায়ের সাথে সংযুক্তির মাধ্যমে নিরাপত্তা অনুভব করে।
- সামাজিক হাসি (Social Smile): প্রায় ৬ সপ্তাহের পর থেকে শিশুরা তাদের পরিচিত মানুষের দিকে হাসতে শুরু করে।
- ভয় এবং চিন্তা: প্রায় ৮ মাস বয়সে শিশুরা অপরিচিত ব্যক্তিদের থেকে ভয় পেতে শুরু করে, যাকে অপরিচিত ব্যক্তির উদ্বেগ (Stranger Anxiety) বলা হয়। এছাড়া, মা-বাবা থেকে দূরে থাকার সময় তারা বিচ্ছিন্নতার ভয় (Separation Anxiety) অনুভব করে।
- নকল করা (Imitation): শিশুরা প্রাপ্তবয়স্কদের এবং তাদের চারপাশের মানুষদের আচরণ অনুকরণ করা শুরু করে, যা সামাজিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৩. বৌদ্ধিক বিকাশ (Cognitive Development):
শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই সময়ে। তারা চারপাশের জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে শুরু করে এবং সমস্যার সমাধান করতে শেখে।
প্রধান বৈশিষ্ট্য:
- পিয়াজের সংবেদী-গতি স্তর (Piaget’s Sensorimotor Stage): জাঁ পিয়াজের মতে, জন্ম থেকে ২ বছর পর্যন্ত শিশু Sensorimotor Stage-এ থাকে, যেখানে তারা তাদের ইন্দ্রিয় ও মোটর ক্রিয়াকলাপ ব্যবহার করে চারপাশের জগৎকে বুঝতে শেখে।
- বস্তু স্থায়িত্ব (Object Permanence): প্রায় ৮-১২ মাসের মধ্যে শিশুরা বুঝতে পারে যে কোনো বস্তু চোখের আড়ালে চলে গেলেও তা থেকে যায়। এটি তাদের জ্ঞানীয় বিকাশের একটি বড় মাইলফলক।
- কারণ ও ফল সম্পর্ক (Cause and Effect Relationship): শিশুরা দেখতে শেখে যে তাদের কার্যকলাপের ফলে কিছু ঘটনা ঘটে। যেমন, খেলনা টানলে তা নড়ে, এটি তারা পর্যবেক্ষণ করে শিখে।
- পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধান (Exploration): শিশুরা তাদের চারপাশের পরিবেশ নিয়ে কৌতূহলী হয়ে ওঠে এবং নতুন নতুন জিনিসের সাথে পরীক্ষামূলক আচরণ করে।
৪. মানসিক বিকাশ (Emotional Development):
শিশুর আবেগিক বিকাশ এই সময়ে গুরুত্বপূর্ণ। তারা বিভিন্ন আবেগ প্রকাশ করতে শেখে এবং তাদের নিজের আবেগ বুঝতে শুরু করে।
প্রধান বৈশিষ্ট্য:
- প্রাথমিক আবেগ: জন্মের পরপরই শিশুরা আনন্দ, কষ্ট, ভয় এবং রাগের মতো মৌলিক আবেগগুলি অনুভব করতে শুরু করে।
- আবেগ প্রকাশ: ৬ মাসের পর থেকে শিশুরা আনন্দ, ভয়, হতাশা এবং সন্তুষ্টির মতো আবেগগুলি পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করতে শুরু করে।
- নিজের অনুভূতি বুঝতে শেখা: শিশুরা ধীরে ধীরে তাদের চারপাশের মানুষের আবেগ বুঝতে শেখে এবং তাদের প্রতিক্রিয়া অনুসারে তাদের নিজের আবেগ প্রকাশ করতে পারে।
- আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা: শিশুরা ধীরে ধীরে তাদের আবেগগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে, বিশেষত পরিচর্যাকারীর সান্ত্বনা বা আদরের মাধ্যমে।
৫. ভাষাগত বিকাশ (Language Development):
ভাষার বিকাশ এই সময়ে দ্রুত এগোয় এবং শিশুরা কথা বলা শিখতে শুরু করে।
প্রধান বৈশিষ্ট্য:
- কান্না: জন্মের পরপরই শিশুরা কান্নার মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনীয়তা প্রকাশ করে।
- কোকে ধরা (Cooing): ২ থেকে ৩ মাসের মধ্যে শিশুরা কোকে ধরা বা কিছু শব্দ উচ্চারণ করা শুরু করে।
- বাবলিং (Babbling): প্রায় ৬ মাসের মধ্যে শিশুরা বিভিন্ন ধ্বনির পুনরাবৃত্তি করে, যেমন “বা-বা”, “দা-দা”। এটি ভাষার বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
- প্রথম শব্দ: ১২ মাসের মধ্যে বেশিরভাগ শিশু তাদের প্রথম শব্দ উচ্চারণ করে, যেমন “মা”, “বাবা”।
- শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধি: ১৮ থেকে ২৪ মাসের মধ্যে শিশুরা প্রায় ৫০-২০০ টি শব্দ শিখে এবং দুই বা তিনটি শব্দের বাক্য তৈরি করতে শেখে (যেমন, “মা খাও”, “বাবা আসো”)।
- ভাষা বোঝার ক্ষমতা: শিশুরা যে শব্দ শুনছে তা অনুকরণ করা এবং তার অর্থ বুঝতে শেখে।
প্রারম্ভিক শৈশবকাল (Early Childhood) [২-৬ বছর]
প্রারম্ভিক শৈশবকাল (Early Childhood) হল ২ থেকে ৬ বছর বয়সের সময়কাল, যা শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, বৌদ্ধিক এবং ভাষাগত বিকাশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে শিশুরা তাদের চারপাশের জগত সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে শুরু করে এবং শেখার প্রচেষ্টায় আগ্রহী হয়ে ওঠে। তাদের মোটর স্কিল, ভাষার দক্ষতা, এবং সামাজিক দক্ষতা উল্লেখযোগ্যভাবে বিকশিত হয়।
প্রারম্ভিক শৈশবকালের বিভিন্ন দিকের বিকাশ:
১. শারীরিক বিকাশ (Physical Development):
এই সময়ে শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি অপেক্ষাকৃত ধীর হয়, তবে মোটর দক্ষতার (Motor Skills) দ্রুত বিকাশ ঘটে।
প্রধান বৈশিষ্ট্য:
- উচ্চতা ও ওজন বৃদ্ধি: এই সময়ে শিশুরা ধীরে ধীরে লম্বা ও শক্তিশালী হয়। বছরে প্রায় ৫-৭ সেন্টিমিটার উচ্চতা বাড়ে এবং ২-৩ কেজি ওজন বাড়তে পারে।
- মোটা মোটর দক্ষতা (Gross Motor Skills):
- শিশুদের শারীরিক ক্রিয়াকলাপের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, তারা দৌড়াতে, লাফাতে, সাইকেল চালাতে, এবং অন্যান্য শারীরিক কার্যকলাপ করতে শেখে।
- তারা বল নিক্ষেপ করতে, ধরতে, এবং অন্যান্য খেলাধুলার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হয়।
- সূক্ষ্ম মোটর দক্ষতা (Fine Motor Skills):
- শিশুদের সূক্ষ্ম মোটর স্কিল উন্নত হয়, যেমন: আঁকাআঁকি করা, রং করা, পেন্সিল বা ব্রাশ ধরতে শেখা।
- এই সময় শিশুরা তাদের নিজের জুতো পরতে, বোতাম লাগাতে, এবং ছোট ছোট খেলনা দিয়ে খেলা করতে শিখে।
২. সামাজিক বিকাশ (Social Development):
প্রারম্ভিক শৈশবকাল হল শিশুদের সামাজিক দক্ষতার বিকাশের সময়। তারা নতুন বন্ধু তৈরি করে এবং সামাজিক নিয়ম শিখতে শুরু করে।
প্রধান বৈশিষ্ট্য:
- পারস্পরিক যোগাযোগের দক্ষতা: শিশুরা তাদের সমবয়সীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে এবং খেলায় অংশ নিতে শেখে।
- সহযোগিতামূলক খেলা (Cooperative Play): ৪-৫ বছর বয়স থেকে শিশুরা একসঙ্গে দলগত খেলায় অংশ নেয় এবং খেলাধুলার নিয়ম মানতে শেখে।
- ভূমিকা পালনের খেলা (Role Play): এই সময়ে শিশুরা প্রায়ই “ডাক্তার-ডাক্তার”, “বাবা-মা”, “রাঁধুনি” ইত্যাদি ভূমিকা পালনের খেলা খেলে। এটি তাদের সামাজিক এবং মানসিক বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
- অপরের অনুভূতি বোঝা: শিশু ধীরে ধীরে তাদের চারপাশের মানুষের আবেগ এবং অনুভূতি বোঝা শুরু করে, যা সহানুভূতির (Empathy) বিকাশ ঘটায়।
- সংস্কৃতি ও সামাজিক মূল্যবোধ: পরিবার এবং সমাজের সংস্কৃতি ও নিয়ম-কানুন সম্পর্কে সচেতন হতে শুরু করে। এই সময়ে তারা শৃঙ্খলা ও সামাজিক নিয়মের গুরুত্ব সম্পর্কে শিখতে শুরু করে।
৩. বৌদ্ধিক বিকাশ (Cognitive Development):
এই সময়ে শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ খুব দ্রুত ঘটে এবং তারা নতুন জ্ঞান ও ধারণা অর্জন করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
প্রধান বৈশিষ্ট্য:
- পিয়াজের প্রি-অপারেশনাল স্তর (Piaget’s Preoperational Stage):
- ২ থেকে ৭ বছর বয়সে শিশু জাঁ পিয়াজের মতে প্রি-অপারেশনাল পর্যায়ে থাকে, যেখানে তারা প্রতীকী চিন্তা (Symbolic Thinking) করতে শেখে। অর্থাৎ, তারা বস্তু ও ঘটনাকে প্রতীক বা চিহ্নের মাধ্যমে বোঝে।
- কল্পনা ও সৃজনশীলতা: শিশুরা কল্পনাশক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন খেলায় অংশ নেয় এবং গল্প তৈরি করে।
- ঈগোসেন্ট্রিজম (Egocentrism): এই বয়সে শিশুরা সাধারণত নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিকে সবকিছুর কেন্দ্র মনে করে এবং অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝা তাদের জন্য কঠিন হয়।
- কারণ ও ফলের সম্পর্ক: তারা সহজ ঘটনা বা কাজের কারণ এবং ফল সম্পর্কে ধারণা পেতে শুরু করে।
- সমস্যা সমাধানের দক্ষতা: তারা ছোট সমস্যার সমাধান করতে শিখে এবং তাদের চিন্তাভাবনায় ক্রমাগত অগ্রগতি ঘটে।
৪. মানসিক বিকাশ (Emotional Development):
প্রারম্ভিক শৈশবকালে শিশুর আবেগিক বিকাশ ঘটে এবং তারা নিজেদের আবেগগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে।
প্রধান বৈশিষ্ট্য:
- আবেগ প্রকাশ: শিশুরা আনন্দ, দুঃখ, রাগ, ভয়, এবং ভালোবাসার মতো বিভিন্ন আবেগ অনুভব করে এবং প্রকাশ করে।
- আত্মপরিচয় গঠন (Self-Concept): এই সময় শিশুদের মধ্যে নিজের সম্পর্কে সচেতনতা এবং আত্মপরিচয়ের ধারণা তৈরি হয়। তারা বুঝতে শেখে, তারা ছেলে বা মেয়ে, এবং তারা কী করতে পারে বা কী পারবে না।
- আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা: শিশুরা ধীরে ধীরে তাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে, যদিও রাগ বা হতাশার মতো আবেগ প্রকাশ করতে মাঝে মাঝে সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে।
- আত্মবিশ্বাসের বিকাশ: বিভিন্ন কাজ করতে শেখার মাধ্যমে তারা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। তাদের সফলতা তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করে এবং তারা নতুন কাজ শেখার প্রতি উৎসাহিত হয়।
৫. ভাষাগত বিকাশ (Language Development):
এই সময়ে শিশুর ভাষাগত দক্ষতা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং তারা ভাষার বিভিন্ন দিক শিখতে শুরু করে।
প্রধান বৈশিষ্ট্য:
- শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধি: ২-৬ বছর বয়সে শিশুরা নতুন নতুন শব্দ শিখে এবং তাদের শব্দভাণ্ডার দ্রুত বাড়ে। ৬ বছর বয়সে বেশিরভাগ শিশু প্রায় ২০০০-২৫০০ শব্দ শিখে ফেলে।
- বাক্যগঠন (Sentence Construction): তারা দীর্ঘ ও জটিল বাক্য তৈরি করতে শেখে। ৩-৪ বছর বয়সে শিশুরা ৪-৫ শব্দের বাক্য ব্যবহার করতে পারে।
- কথোপকথন (Conversation Skills): তারা ধীরে ধীরে কথোপকথনে অংশ নিতে শিখে। তারা একে অপরের সাথে অর্থপূর্ণভাবে কথা বলতে পারে এবং সংলাপ চালিয়ে যেতে পারে।
- কথার স্পষ্টতা (Speech Clarity): এই সময়ে শিশুরা শব্দ ও বাক্যগুলো পরিষ্কারভাবে উচ্চারণ করতে শেখে। তবে কিছু ক্ষেত্রে শিশুদের ভাষাগত বিকাশের জন্য অতিরিক্ত সহায়তা প্রয়োজন হতে পারে।
- প্রশ্ন করা (Questioning): শিশুরা তাদের জ্ঞান সম্প্রসারণের জন্য বারবার প্রশ্ন করে। তারা প্রায়ই “কেন?”, “কীভাবে?”, “কোথায়?” এর মতো প্রশ্নগুলো করতে থাকে।
প্রাথমিক শৈশবকাল (Middle Childhood) [৬-১২ বছর]
প্রাথমিক শৈশবকাল (Middle Childhood) হল সাধারণত ৬ থেকে ১২ বছর বয়সের সময়কাল। এই সময়ের মধ্যে শিশুদের শারীরিক, বৌদ্ধিক, সামাজিক, মানসিক, নৈতিক এবং ভাষাগত বিকাশ উল্লেখযোগ্যভাবে ঘটে। এটি একটি সংক্রমণ সময় যেখানে শিশুরা ধীরে ধীরে নির্ভরশীলতা থেকে স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে এবং বিদ্যালয়, পরিবার ও সমবয়সীদের সঙ্গে গভীরতর সম্পর্ক গড়ে তোলে।
১. শারীরিক বিকাশ (Physical Development):
প্রধান বৈশিষ্ট্য:
- উচ্চতা ও ওজন বৃদ্ধি: এই সময়ের মধ্যে শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধি ধীরে ধীরে হয়। তবে শারীরিক গঠন আরও স্থিতিশীল এবং সমতলভাবে বৃদ্ধি পায়।
- মোটর স্কিলের উন্নতি (Motor Skills Development):
- মোটা মোটর দক্ষতা (Gross Motor Skills): শিশুদের শারীরিক সক্ষমতা আরও উন্নত হয় এবং তারা আরও জটিল শারীরিক কাজ করতে সক্ষম হয়। যেমন: দৌড়ানো, লাফানো, সাইকেল চালানো, এবং বিভিন্ন খেলাধুলার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ।
- সূক্ষ্ম মোটর দক্ষতা (Fine Motor Skills): শিশুদের সূক্ষ্ম মোটর দক্ষতা আরও নিখুঁত হয়ে ওঠে। যেমন: লেখা, আঁকা, রং করা এবং ছোট ছোট বস্তুগুলি সুন্দরভাবে পরিচালনা করা।
- স্বাস্থ্যের পরিবর্তন: কিছু শিশুদের এই সময়ের মধ্যে দাঁতের পরিবর্তন শুরু হয়। দুধ দাঁত পড়ে গিয়ে স্থায়ী দাঁত গজানো শুরু হয়।
- শারীরিক সক্ষমতার বৃদ্ধি: শিশুরা তাদের দৈনন্দিন কাজগুলোতে স্বাধীনভাবে অংশ নিতে সক্ষম হয়। খেলাধুলা, দলগত খেলা এবং বিভিন্ন শারীরিক কার্যকলাপে তারা আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
২. সামাজিক বিকাশ (Social Development):
প্রধান বৈশিষ্ট্য:
- সমবয়সীদের সাথে সম্পর্ক (Peer Relationships): এই বয়সে সমবয়সীদের সাথে সম্পর্ক এবং বন্ধুত্ব খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তারা তাদের বন্ধুদের সাথে দলগত কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করে এবং বিভিন্ন সামাজিক মানসিকতা তৈরি করে।
- দলগত খেলা (Group Play): শিশুরা দলগত খেলায় আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং ক্রীড়া, দলগত কাজ, এবং সহযোগিতামূলক খেলার মাধ্যমে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলে।
- পারিবারিক সম্পর্কের পরিবর্তন: শিশুরা ধীরে ধীরে বাবা-মায়ের কাছ থেকে স্বাধীন হয়ে ওঠে এবং তাদের সামাজিক বৃত্ত প্রসারিত হয়। তারা তাদের পরিবার ও বিদ্যালয়ের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করতে শেখে।
- ভূমিকা ও পরিচয় গঠন: শিশুরা ধীরে ধীরে নিজেদের সম্পর্কে ধারণা তৈরি করতে শুরু করে। তারা কোনটি সঠিক বা ভুল, এবং নিজেদের শক্তি ও দুর্বলতা সম্পর্কে সচেতন হতে থাকে।
- অন্যদের সাথে সহযোগিতা: শিশুদের মধ্যে অন্যদের সাথে সহযোগিতা করা এবং দলগত কাজ করার প্রবণতা বাড়ে। দলগত কাজের মাধ্যমে তারা কীভাবে সমস্যা সমাধান করতে হয় তা শেখে।
৩. বৌদ্ধিক বিকাশ (Cognitive Development):
প্রধান বৈশিষ্ট্য:
- পিয়াজের কংক্রিট অপারেশনাল পর্যায় (Piaget’s Concrete Operational Stage):
- প্রায় ৭ থেকে ১১ বছর বয়সের মধ্যে শিশুরা পিয়াজের মতে কংক্রিট অপারেশনাল স্তরে থাকে। এই স্তরে শিশুরা যৌক্তিক চিন্তা করতে শেখে এবং বাস্তব ঘটনাগুলোর বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হয়।
- সংরক্ষণ (Conservation): তারা বুঝতে শেখে যে কোনো বস্তু বা পরিমাণের আকার বা রূপ পরিবর্তন করলেও তার ভর, সংখ্যা, বা আয়তন অপরিবর্তিত থাকে।
- শ্রেণীকরণ (Classification): শিশুরা বিভিন্ন জিনিসকে শ্রেণীকরণ করতে পারে এবং একাধিক মানদণ্ডে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়।
- কারণ ও ফল সম্পর্ক (Cause and Effect): শিশুরা কারণ ও ফলাফলের মধ্যে সম্পর্ক বুঝতে শুরু করে এবং যৌক্তিক সমাধান বের করতে সক্ষম হয়।
- সমস্যা সমাধান (Problem Solving): শিশুরা তাদের চারপাশের সমস্যাগুলোর সমাধান করতে শিখে এবং তাদের চিন্তাশক্তি বিকশিত হয়। তারা আরও জটিল সমস্যাগুলোর সমাধান করতে আগ্রহী হয়।
- মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি: এই সময়ে শিশুদের মনোযোগ দেয়ার ক্ষমতা এবং স্মৃতিশক্তি উন্নত হয়। তারা দীর্ঘ সময় ধরে কোনো কাজের প্রতি মনোযোগ ধরে রাখতে সক্ষম হয় এবং শিখতে শুরু করে কীভাবে তথ্য সংরক্ষণ করতে হয়।
- স্কুল ও শিক্ষার প্রভাব: শিশুরা এই সময়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রসর হয়। তারা ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান, এবং অন্যান্য বিষয়ে আরও ভালো ধারণা অর্জন করে এবং শেখার প্রতি আগ্রহী হয়।
৪. মানসিক বিকাশ (Emotional Development):
প্রধান বৈশিষ্ট্য:
- আবেগ নিয়ন্ত্রণ (Emotional Regulation): শিশুরা ধীরে ধীরে তাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে। তারা রাগ, হতাশা, বা দুঃখের মতো আবেগগুলোকে সঠিকভাবে প্রকাশ করতে শিখে।
- আত্মপরিচয় গঠন (Self-Concept): শিশুরা তাদের নিজস্ব পরিচয় নিয়ে সচেতন হয়ে ওঠে। তারা নিজেদের সম্পর্কে ইতিবাচক বা নেতিবাচক ধারণা তৈরি করতে থাকে, যা তাদের আত্মবিশ্বাসে প্রভাব ফেলে।
- আত্মবিশ্বাস এবং আত্মমূল্য: তারা বিভিন্ন কাজে সফলতা পেলে আত্মবিশ্বাসী হয়। সফলতা ও ব্যর্থতা উভয়েই তাদের আত্মমূল্য তৈরি করতে সাহায্য করে।
- সমবয়সীদের প্রভাব: এই সময়ে শিশুরা সমবয়সীদের মতামতের উপর গুরুত্ব দেয় এবং তাদের মধ্যে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার জন্য আকাঙ্ক্ষা বেড়ে যায়।
- আবেগ প্রকাশের মাধ্যম: শিশুরা তাদের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে এবং পরিবারের সদস্যদের সাথে তাদের আবেগ শেয়ার করতে শুরু করে।
৫. নৈতিক বিকাশ (Moral Development):
প্রধান বৈশিষ্ট্য:
- কোলবার্গের নৈতিক উন্নয়নের তত্ত্ব (Kohlberg’s Moral Development Theory):
- প্রাক-প্রথাগত নৈতিকতা (Pre-Conventional Morality): এই সময়ে শিশুদের নৈতিক বিকাশের প্রথম ধাপ হয়, যেখানে তারা পুরস্কার এবং শাস্তির ভিত্তিতে সঠিক ও ভুল নির্ধারণ করে।
- প্রথাগত নৈতিকতা (Conventional Morality): শিশু ধীরে ধীরে সমাজের নিয়ম-কানুন বুঝতে শুরু করে এবং সামাজিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে নৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে শেখে।
- সঠিক ও ভুলের ধারণা (Sense of Right and Wrong): শিশুরা বুঝতে শেখে কী সঠিক আর কী ভুল। তারা সামাজিক নিয়ম মেনে চলতে আগ্রহী হয় এবং তাদের আচরণে নৈতিকতা প্রকাশ পায়।
- আবেগিক প্রতিক্রিয়া: শিশুদের মধ্যে দায়িত্ববোধ এবং নৈতিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়তে থাকে। তারা অন্যদের আবেগ এবং অনুভূতি বিবেচনা করে কাজ করার চেষ্টা করে।
৬. ভাষাগত বিকাশ (Language Development):
প্রধান বৈশিষ্ট্য:
- শব্দভাণ্ডারের বৃদ্ধি (Vocabulary Expansion): এই সময়ে শিশুদের শব্দভাণ্ডার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। ৬-১২ বছর বয়সে তাদের ভাষাগত দক্ষতা আরও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।
- বাক্যগঠনের উন্নতি (Sentence Structure Improvement): শিশুরা দীর্ঘ এবং জটিল বাক্য ব্যবহার করতে শেখে। তারা সঠিক ব্যাকরণ ব্যবহার করতে এবং নানা ধরনের বাক্য রচনা করতে সক্ষম হয়।
- কথোপকথনের দক্ষতা (Conversation Skills): শিশুদের কথোপকথনের দক্ষতা আরও উন্নত হয় এবং তারা সামাজিক পরিস্থিতিতে ভালোভাবে কথা বলতে সক্ষম হয়। তারা বিভিন্ন প্রসঙ্গে উপযুক্ত ভাষা ব্যবহার করতে শিখে।
- পড়ার এবং লেখার দক্ষতা (Reading and Writing Skills): বিদ্যালয়ে শিশুরা তাদের পড়ার এবং লেখার দক্ষতা আরও উন্নত করে। তারা দীর্ঘ গল্প বা প্রবন্ধ লিখতে সক্ষম হয় এবং পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়ে।
- সমালোচনামূলক চিন্তা: তারা বিভিন্ন বিষয় বিশ্লেষণ করে এবং সমালোচনামূলক চিন্তাধারার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। শিশুরা যুক্তি এবং বিবেচনা ব্যবহার করে বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে সম্পর্ক বুঝতে শিখে।
কৈশোরকাল (Adolescence) [ ১২ থেকে ১৮]
কৈশোরকাল (Adolescence) হল ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সের সময়কাল, যা শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, এবং বৌদ্ধিক বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল পর্যায়। এই সময়ে শিশুরা প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের দিকে ধাবিত হয় এবং তাদের সারা জীবনের জন্য মূল ভিত্তি গড়ে তোলে। কৈশোরকাল সাধারণত দুইটি প্রধান ধাপে বিভক্ত: প্রাথমিক কৈশোর (Early Adolescence) এবং বৃদ্ধি (Late Adolescence)।
১. শারীরিক বিকাশ (Physical Development):
প্রাথমিক কৈশোর (Early Adolescence):
- বৃদ্ধি স্পার্ট (Growth Spurts): প্রাথমিক কৈশোরে, শরীরের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে। উচ্চতা এবং ওজন দ্রুত বৃদ্ধি পায়, বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে এই পরিবর্তনটি প্রায় ১০-১২ বছর বয়সে শুরু হয়, এবং ছেলেদের মধ্যে ১২-১৪ বছর বয়সে।
- যৌন পরিণতি (Sexual Maturation): মেয়েদের মধ্যে মেনার্ক (Menarche) অর্থাৎ মাসিক ঋতুস্রাব শুরু হয়। ছেলেদের মধ্যে পিউবার্টি বা যৌন পরিণতির লক্ষণ যেমন: মুখের ত্বকে লোমকূপ, গলার স্বরের পরিবর্তন ইত্যাদি ঘটে।
বৃদ্ধিকাল (Late Adolescence):
- শারীরিক স্থিতি (Physical Stability): বয়স বাড়ার সাথে সাথে শারীরিক বৃদ্ধি কিছুটা ধীর হয়। শরীরের গঠন ও আকার প্রায় পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠে। মেয়েদের মধ্যে সাধারণত বয়স ১৬-১৮ বছর এবং ছেলেদের মধ্যে ১৮-২০ বছর বয়সে শারীরিক পরিবর্তন সম্পূর্ণ হয়।
- সাধারণ শারীরিক পরিবর্তন: হাড়ের গঠন, পেশির বৃদ্ধি, এবং শারীরিক গঠনে সামঞ্জস্য আসে।
২. মানসিক বিকাশ (Cognitive Development):
প্রাথমিক কৈশোর:
- ফরমাল অপারেশনাল স্তর (Formal Operational Stage): জাঁ পিয়াজের মতে, কৈশোরে শিশুরা ফরমাল অপারেশনাল স্তরে প্রবেশ করে। তারা যৌক্তিকভাবে চিন্তা করতে পারে, সম抽 চিন্তা করতে পারে, এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে সক্ষম হয়।
- আবস্ট্র্যাক্ট চিন্তা (Abstract Thinking): চিন্তাশক্তি আরও উন্নত হয়। তারা জটিল ধারণা এবং তত্ত্বগুলি বোঝতে সক্ষম হয়, এবং বিভিন্ন সম্ভাবনার মধ্যে তুলনা করতে পারে।
- সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা: তারা বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলোর সমাধান করতে সক্ষম হয় এবং ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে কৌশল ব্যবহার করতে শেখে।
বৃদ্ধিকাল:
- সমালোচনামূলক চিন্তা (Critical Thinking): কৈশোরের শেষ পর্যায়ে তারা আরও ভালোভাবে যুক্তি এবং বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হয়। তারা তাদের মতামত গঠন করতে এবং যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
- নিজস্ব চিন্তাধারা (Self-Concept): তারা নিজেদের চিন্তাধারা ও মূল্যবোধ সম্পর্কে আরও পরিষ্কার ধারণা পেতে শুরু করে এবং এই বিষয়গুলো তাদের ব্যক্তিত্বের অংশ হয়ে ওঠে।
৩. সামাজিক বিকাশ (Social Development):
প্রাথমিক কৈশোর:
- স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা (Desire for Independence): কৈশোরের শুরুতে শিশুরা তাদের পরিবারের কাছ থেকে স্বতন্ত্র হতে চায় এবং নিজের পরিচয় গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়।
- বন্ধুত্ব ও সামাজিক সম্পর্ক: বন্ধুদের সাথে সম্পর্কের গুরুত্ব বাড়ে। তারা নতুন সামাজিক পরিবেশে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় এবং বন্ধুত্বের মাধ্যমে মানসিক সমর্থন পেতে চায়।
- অপরিচিত পরিবেশ (Peer Pressure): এই সময়কাল একটি সমবয়সীদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার প্রবণতা থাকে, যা সামাজিক আচরণ এবং সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতে পারে।
বৃদ্ধিকাল:
- পরিবারের সাথে সম্পর্কের পরিবর্তন: কৈশোরের শেষ পর্যায়ে শিশুরা পরিবারের সদস্যদের সাথে সম্পর্কের ভারসাম্য তৈরি করতে শেখে। তারা স্বাধীনতা এবং পরিবারের সহযোগিতা মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে চেষ্টা করে।
- মৌলিক সামাজিক মূল্যবোধ (Core Social Values): তারা সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতাকে আরো গভীরভাবে বোঝে এবং তার ভিত্তিতে নিজেদের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে।
৪. মানসিক বিকাশ (Emotional Development):
প্রাথমিক কৈশোর:
- আবেগিক পরিবর্তন (Emotional Fluctuations): আবেগের অস্থিরতা ও পরিবর্তন খুব স্বাভাবিক। তারা দ্রুত রাগ, দুঃখ, আনন্দ এবং হতাশার মত বিভিন্ন অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে।
- স্ব-পরিচয় (Self-Identity): তারা নিজের পরিচয় ও স্ব-মূল্য নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করে। এই সময়কাল তাদের আত্মপরিচয়ের ভিত্তি গড়ে তোলে।
- আত্মবিশ্বাস (Self-Esteem): তাদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পেতে পারে, তবে এটি চ্যালেঞ্জিং হতে পারে, বিশেষ করে যখন তারা সামাজিক সমর্থন বা স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টা করে।
বৃদ্ধিকাল:
- নিজের আবেগের নিয়ন্ত্রণ (Emotional Regulation): কৈশোরের শেষ পর্যায়ে তারা নিজেদের আবেগকে আরও ভালভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। তারা আবেগ প্রকাশের কৌশল উন্নত করে এবং সামাজিক পরিস্থিতিতে স্থিতিশীলতা আনে।
- বৈশ্বিক চিন্তা (Global Thinking): তাদের আবেগে গভীরতা আসে এবং তারা জীবনের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করে।
৫. নৈতিক বিকাশ (Moral Development):
প্রাথমিক কৈশোর:
- নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ (Development of Moral Values): তারা সঠিক এবং ভুলের ধারণা আরও উন্নত করে এবং সামাজিক নৈতিকতাকে গুরুত্ব দিতে শুরু করে। তারা বিভিন্ন সামাজিক ও নৈতিক প্রশ্নের উত্তর খোঁজে।
- সামাজিক নীতি (Social Norms): তারা সামাজিক নীতিগুলি বোঝার চেষ্টা করে এবং নিজেদের আচরণের সাথে সামাজিক প্রত্যাশা মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।
বৃদ্ধিকাল:
- সুনির্দিষ্ট নৈতিক ধারণা (Mature Moral Reasoning): তারা নিজস্ব নৈতিক ধারণা তৈরি করতে সক্ষম হয় এবং সমাজের মূল নৈতিক মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেয়।
- নৈতিক সিদ্ধান্তের স্বীকৃতি (Recognition of Moral Choices): তারা জীবনের বিভিন্ন দিকের নৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং তাদের কর্মের ফলাফল সম্পর্কে সচেতন হয়।
৬. ভাষাগত বিকাশ (Language Development):
প্রাথমিক কৈশোর:
- ভাষার দক্ষতা (Language Proficiency): ভাষাগত দক্ষতা আরও উন্নত হয়। তারা জটিল বাক্য এবং উপকরণের ব্যবহার করতে সক্ষম হয়।
- তর্কবিতর্ক এবং যুক্তি (Debate and Argumentation): তারা যুক্তিসঙ্গত তর্কবিতর্ক করতে শিখে এবং বিভিন্ন মতামত প্রকাশ করতে সক্ষম হয়।
বৃদ্ধিকাল:
- নিউজ পেশার দক্ষতা (Advanced Communication Skills): তারা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে উপযুক্ত ভাষা ব্যবহার করতে শেখে এবং প্রভাবশালী উপস্থাপনা করতে পারে।
- বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার (Use of Wit and Humor): তাদের ভাষায় বুদ্ধিমত্তা ও হাস্যরস ব্যবহারের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তারা সামাজিক পরিস্থিতিতে আরও সৃজনশীলভাবে ভাষা ব্যবহার করতে পারে।
প্রারম্ভিক প্রাপ্তবয়স্কত্ব (Emerging Adulthood) [১৮ থেকে ২৫]
প্রারম্ভিক প্রাপ্তবয়স্কত্ব (Emerging Adulthood) হল ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সের সময়কাল, যা কৈশোরের পর এবং পূর্ণবয়স্ক জীবনের প্রারম্ভিক পর্যায়। এটি একটি বিশেষ জীবনকাল যেখানে অনেক তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের মতো নয়, কিন্তু তারা এখনও পরিপূর্ণ প্রাপ্তবয়স্কতার দোরগোড়ায় পৌঁছায়। এই সময়ে তাদের জীবনের বিভিন্ন দিক যেমন শিক্ষা, কর্মজীবন, সম্পর্ক এবং ব্যক্তিত্বের উন্নতি ঘটে।
১. শারীরিক বিকাশ (Physical Development):
প্রধান বৈশিষ্ট্য:
- শারীরিক পূর্ণতা (Physical Maturity): প্রারম্ভিক প্রাপ্তবয়স্কত্বে শারীরিক বৃদ্ধি সম্পন্ন হয়। পেশী এবং হাড়ের শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং শরীরের গঠন প্রায় পূর্ণাঙ্গ হয়।
- স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা (Health and Well-being): এই সময়ে শারীরিক স্বাস্থ্য সাধারণত ভাল থাকে। তারা সুস্থতার প্রতি যত্ন নেয় এবং নিজেদের শারীরিক ফিটনেস উন্নত করতে চেষ্টা করে।
- যৌন সুস্থতা (Sexual Health): যৌন স্বাস্থ্যের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। প্রাপ্তবয়স্কতা এবং সম্পর্কের মধ্যে যৌন সুস্থতার বিষয়ে অবগত হয়।
২. বৌদ্ধিক বিকাশ (Cognitive Development):
প্রধান বৈশিষ্ট্য:
- সারাংশ চিন্তা (Complex Thinking): এই সময় তরুণরা জটিল চিন্তা করতে পারে এবং কল্পনাশক্তির মাধ্যমে নতুন নতুন ধারণা তৈরি করতে সক্ষম হয়। তারা সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে।
- ফরমাল অপারেশনাল চিন্তা (Formal Operational Thought): কগনিটিভ থিওরিস্ট জঁ পিয়াজে এর মতে, প্রাপ্তবয়স্কত্বে তারা ফরমাল অপারেশনাল চিন্তার পর্যায়ে পৌঁছায়। এতে যুক্তি এবং ধারণা সম্পর্কে গভীর বোঝাপড়া ঘটে।
- নিজস্ব চিন্তাভাবনা এবং মূল্যবোধ (Personal Beliefs and Values): এই সময়ে তারা নিজের চিন্তাভাবনা, মূল্যবোধ এবং জীবনবোধ নিয়ে চিন্তা করে এবং তাদের বিশ্বাস ও মতামত গড়ে তোলে।
৩. সামাজিক বিকাশ (Social Development):
প্রধান বৈশিষ্ট্য:
- স্বাধীনতা ও আত্ম-উন্নয়ন (Independence and Self-Development): তরুণরা পরিবার থেকে স্বাধীন হতে শুরু করে এবং তাদের ব্যক্তিগত পরিচয় এবং জীবনের লক্ষ্য স্থির করতে চায়।
- সম্পর্ক এবং সম্পর্কের ধরন (Relationships and Relationship Dynamics): তারা বন্ধুত্ব, প্রেমের সম্পর্ক, এবং সামাজিক সম্পর্কগুলোর গভীরতা বোঝে। সম্পর্কের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ব্যাখ্যা পরিবর্তিত হয়।
- কর্মজীবন এবং পেশা (Career and Professional Life): এই সময় তারা নিজের কর্মজীবনের দিক নির্বাচন করে এবং পেশাগত দক্ষতা অর্জন করতে শুরু করে। চাকরি, শিক্ষা, এবং অন্যান্য পেশাগত পরিকল্পনা নিয়ে তারা চিন্তা করে।
৪. মানসিক বিকাশ (Emotional Development):
প্রধান বৈশিষ্ট্য:
- আত্মপরিচয় ও আত্মমর্যাদা (Self-Identity and Self-Esteem): তারা নিজেদের সম্পর্কে আরও পরিষ্কার ধারণা পায় এবং আত্মপরিচয় গড়ে তোলে। আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং তারা তাদের ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য নিয়ে চিন্তা করে।
- মানসিক স্থিতিশীলতা (Emotional Stability): তাদের মানসিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং তারা আবেগগুলো আরও ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়।
- বৃহত্তর আত্ম-বোধ (Enhanced Self-Awareness): তারা নিজের আবেগ এবং আচরণ সম্পর্কে আরও সচেতন হয়ে ওঠে এবং নিজেদের শক্তি ও দুর্বলতা বিশ্লেষণ করে।
৫. নৈতিক বিকাশ (Moral Development):
প্রধান বৈশিষ্ট্য:
- নৈতিক মূল্যবোধের গঠন (Formation of Moral Values): তারা নিজের নৈতিক মূল্যবোধ এবং নৈতিক বিশ্বাস গড়ে তোলে। তাদের নৈতিক চিন্তা আরও উন্নত হয় এবং তারা সামাজিক ও ব্যক্তিগত নীতির প্রতি দায়িত্বশীল হয়।
- জীবনবোধ এবং লক্ষ্য (Life Goals and Purpose): তারা জীবনের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং তাদের নৈতিক আদর্শ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করার চেষ্টা করে।
৬. ভাষাগত বিকাশ (Language Development):
প্রধান বৈশিষ্ট্য:
- ভাষার প্রজ্ঞা (Language Proficiency): ভাষার দক্ষতা আরও পরিপক্ক হয়। তারা সৃজনশীলভাবে ভাষা ব্যবহার করতে সক্ষম হয় এবং বিভিন্ন সামাজিক ও প্রাত্যহিক পরিস্থিতিতে উপযুক্ত ভাষা প্রয়োগ করে।
- যোগাযোগের দক্ষতা (Communication Skills): তাদের যোগাযোগের দক্ষতা উন্নত হয়। তারা যুক্তিযুক্তভাবে এবং স্বচ্ছভাবে নিজেদের ভাবনা এবং মতামত প্রকাশ করতে সক্ষম হয়।